বাংলাদেশ
বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: শেখ মুজিবুর রহমান – ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির মাধ্যমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা

দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর জীবন-কথা।
শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠিকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিল।
“…মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার এবং মা সায়েরা খাতুন।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে।
খুবই অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন সম্পর্কে আত্মীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে।
নয় বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এবং পরে ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে।
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কাশ্মিরী বংশোদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা মি.সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রাভাবিত করেছিলেন।
উনিশশ’ ৪২ সালে এট্রান্স পাশ করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন।

তবে স্কুল জীবন থেকেই তিনি তাঁর নেতৃত্ব দেবার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।
তিনি ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে এবং ১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের সম্মেলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন।
শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে এবং এ সময়েই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই বছরই প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এসময় তিনি পাকিস্তানে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বেঙ্গল মুসলিম লীগের হয়ে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকেই ১৯৪৭ সালে তিনি বি.এ. পাশ করেন এবং ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীদের বিক্ষোভে ‘উস্কানি’ দেবার অভিযোগ এনে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় আইন পড়া তাঁর শেষ হয়নি।

তিনি ১৯৪৮ সালে জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি একজন অন্যতম প্রধান ছাত্র নেতায় পরিণত হন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন সমাজতন্ত্রের দিকে এবং মনে করতেন দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য একমাত্র পথ সমাজতন্ত্রের বিকাশ।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেবার পর এর বিরুদ্ধে যে গণ আন্দোলন শুরু হয়, সে আন্দোলনে একটা অগ্রণী ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবের।
বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাভোগ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন এবং তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নামে যে বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠিত হয়েছিল, তার মূল দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন। এই জোটের টিকেটে ১৯৫৪র নির্বাচনে গোপালগঞ্জ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁকে তখন কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার ওই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়।
এই অনুষ্ঠান তৈরির সময় ঢাকায় প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে এসে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দলটিকে শক্তিশালী করেছিলেন।
উনিশশ’ ৫৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব আবার দলের মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করা হয়। সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সংগ্রামের কারণে তাঁকে কয়েক বছর আবার জেল খাটতে হয়েছিল।
এরপর ১৯৬১ সালে অন্যান্য সাধারণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গোপনে তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা।

বিবিসি বাংলাকে আতাউস সামাদ বলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব নেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “ছয় দফা দাবি” পেশ করেন।
“শেখ সাহেব সাহস করে ছয় দফা ঘোষণা করলেন, তাও করলেন তিনি লাহোরে। পশ্চিম পাকিস্তানে একটা সম্মেলনে গিয়ে তিনি ওই ছয় দফা ঘোষণা করলেন, যার ফলে ওঁনাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে যে মামলাটি হয় তাতে এক নম্বর আসামী করা হলো ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি,” বলেন আতাউস সামাদ।
এই মামলায় বলা হয়েছিল শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগী বাঙালি কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে।
ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় তা এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই গণ আন্দোলন বা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত এই মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়।

“ওঁনাকে ছাড়ানোর জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল যেটা ছাত্রদের ১১ দফায় রূপ নিয়েছিল, সেইখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিনই তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো,” বলেন আতাউস সামাদ।
রেস কোর্স ময়দানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এক বিশাল জনসভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।
উনিশশ’ ৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিব তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে মূল বক্তব্য হিসাবে তুলে ধরেছিলেন, বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের অনেকগুলো নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি দেখেছেন সব জায়গাতেই তাঁকে ছয় দফা নিয়ে কথা বলতে।
“ছয় দফা না বলে আঙুল তুলে বলতেন আমার দাবি ‘এই’ অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করতে হবে,” বলেছিলেন মি. সামাদ। এই দাবিকে শেখ মুজিব ব্যাখ্যা করেছিলেন ”আমাদের বাঁচার দাবি” হিসাবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পল্টনে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় জনগণের কত কাছাকাছি তিনি চলে এসেছেন। এটা আমি বলব একটা পালাবদল। কারণ এই বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।
“আরেকটি হচ্ছে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত, নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্টই প্রমাণ করেছিল যে বাঙালির তিনি একমাত্র মুখপাত্র। এটা কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে দিয়েছিল বলে আমি মনে করি,” বলেছিলেন ড. কামাল হোসেন।
এই ছয় দফা দাবির পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল তীব্র গণ আন্দোলন ।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের তিনটি বড় গুণ ছিল তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং আপোসহীন।

“পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রধান দ্বন্দ্ব কী সেটাকে তিনি খুব সঠিকভাবে চিহ্ণিত করতে পেরেছিলেন। অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই তিনি জেনে নিয়েছিলেন যে বাঙালির সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বটাই ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব। তাঁর মধ্যে অসাধারণ একটা আকর্ষণী শক্তি ছিল- ক্যারিশমা। তিনি জনগণকে বুঝতেন, জনগণের সঙ্গে মিশতে পারতেন, তাদের ভাষা জানতেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন।”
মি. সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিব যখন ঘোষণা করলেন যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্তারা তাঁকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার তকমা দিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে ওই নির্বাচনী ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ তৈরি করল। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, শেখ মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করলেন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারল যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানালেন। যার মধ্যে দিয়ে শুরু হল বাংলাদেশের নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম।
শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে আতাউস সামাদ বলেছিলেন, “রেস কোর্সে তিনি এমন একটা বক্তৃতা দিলেন যা সবার মন ছুঁয়ে গেল, সবাই ওঁনার নির্দেশ মানতে লাগল। ওঁনার নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধ চলল নয় মাস।”
শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হলো। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর দশই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি থাকার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা।
কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দিতে শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে থাকলেন। ১৯৭৫-এ কয়েকটি দল মিলে গঠন করা হলো বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে বাকশাল নামে রাজনৈতিক দল। বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বদলে শেখ মুজিব নিজেকে আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন।

বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রচারের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার মূল্যায়নে বলেছিলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, গণতন্ত্র অর্থাৎ পশ্চিমী ধাঁচের যে গণতন্ত্র, যার উপর বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছিল, সেই অবস্থান থেকে তিনি ক্রমাগত সরে এসেছিলেন।
“একদলীয় যে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা নির্দ্বিধায় বলা যায় গণতন্ত্র পরবর্তী ব্যবস্থা। সারা দেশে যখন একটা চরম বিশৃঙ্খলা, সেই সময় অন্তত আমার কাছে মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধু এমন একটা ভাবনায় পরিবেষ্টিত থাকতেন যে, গোটা পরিস্থিতিটি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের যে বাড়িটি থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যে বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করেছিল ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের রাতে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫-সালে ১৫ই অগাস্টের রাতে সেই বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে নিহত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নে: ”বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার যে উদ্ভব সেটির চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘অনুঘটক নেতৃত্বের’ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কাজেই তিনি ইতিহাসের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছেন। বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে।”
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, “১৯৪৭ থেকে ‘৭১ এই সময়টুকুতে অনেক নেতাকে আমরা পেয়েছি। যাদের অবদান কম নয়। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের ভাবনা, চেতনা, অভিলক্ষ্য, স্বপ্ন সবকিছুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন একজনই- তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।”
এগ্রোবিজ
পতিত জমিতে চিনাবাদাম চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক

মেহেরপুর: পতিত ও অনুর্বর বেলে মাটির জমিতে চিনাবাদাম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মেহেরপুরের চাষিরা। ফলন ও বাজার দর ভালো এবং কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন এই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদামের চাষ।
সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, শ্যামপুর, টেংগারমাঠ ও গোপালপুর গ্রামের অধিকাংশ জমির মাটি বেলে। ফলে এই এলাকার চাষিরা ধান, গম, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না।
ধান কাটার পর এ সব জমি সাধারণত পতিত থাকে। এজন্য ৯০ দিনের ফসল হিসেবে অল্প খরচে বাদাম চাষ করছেন এলাকার চাষিরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার বাদাম চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। এবার এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা সেক্ষেত্রে বাদামের ফলন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ। আর এ ফলনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘরে তুলছেন তারা। বাজারে প্রতিমণ বাদাম বিক্রি হচ্ছে ২৭শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা গ্রামের বাদাম চাষি খাঁজা আহমেদ, কাওছার আলী ও ফিরোজ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এলাকার মাটি বেলে হওয়ায় সাধারণত সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। সে সময়ে চিনা বাদামের চাষ করা হয়। বাদাম চাষে খরচ কম এবং উৎপাদন ও বাজার দর ভাল। তাই দিন দিন চাষিরা তাদের পতিত জমিতে চিনা বাদামের চাষ শুরু করছেন।
এছাড়া বাদাম ছাড়ানো, শুকানোসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন এখানকার নারীরা। বাদামের গাছ আবার শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করছেন গৃহিণীরা।
নারী শ্রমিক সাহানা খাতুন ও জরিমন নেছা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাদাম ছাড়ানো ও শুকানোর কাজ করে থাকি। এলাকার ২৫/৩০ জন নারী শ্রমিক এ কাজ করে আসছেন।
গৃহিণী সাজেদা খাতুন ও জামেলা খাতুন জানান, বাদামের লতা জালানি হিসেবে বেশ ভাল। তাই লতাও বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আক্তারুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, চিনা বাদামের চাষ সাধারণত পতিত জমিতে হয়ে থাকে। এলাকার চাষিরা এই জমিতে বাদামের চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। তাই বাদাম চাষ যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেজন্য কৃষি বিভাগ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে।
এগ্রোবিজ
সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের সম্ভাবনা

সিলেট বিভাগের উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক জমিতে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানিরা মৌলভীবাজারের আকবরপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন। এ ফুল চাষ মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, যশোরে বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ হয়। যার বাজার দর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। যশোরের ফুল সারাদেশের পাশাপাশি সিলেটেও আসে প্রচুর। সিলেটে ফুলের বাজার শত কোটি টাকার উপরে। কিন্তু সিলেটে ফুলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে হয় না।

সিলেট বিভাগের মাটি অ্যাসিডিক হওয়ায় ফুল চাষ করা যাবে না, সেটাই ছিল প্রচলিক ধারণা। কিন্তু এ ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে ভুল প্রমাণ করেছেন মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক। মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম শরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিটিক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল চাষ করে সফল হয়েছেন তারা। এ পরীক্ষামূলক চাষে ফলনও হয়েছে ভালো। তাই সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে অনেক জায়গা অনাবাদি ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রবাসীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। এ জমিকে আবাদের আওতায় আনতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের উদ্যোগ নিয়ে আগ্রহী ১০০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর এ অঞ্চলের অনেক জমি পতিত থাকে। ফলে ফুল চাষ করে অনাবাদি জমি থেকে কোটি টাকা উপার্জন সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিরানা আক্তার সুমি জানান, চাষিরা প্রশিক্ষণ শেষে অনেক কিছু শিখেছেন। কী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হয়, তা জেনেছেন। ধানের চেয়ে যেহেতু ফুলের দাম বেশি, তাই ফুল চাষে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সরফ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভালোভাবে জমি চাষ করে নির্দেশিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্য ফসলের মতোই এর চাষ পদ্ধতি সহজ। বেড তৈরি করে ফুল চাষ করতে হয়। প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ যে কোন মাপের হতে পারে। তবে প্রস্থে ১.২-১.৫ মিটার হলে ভালো।’

তিনি বলেন, ‘কলম (বীজ) লাগানো থেকে তিন মাস পর স্টিক সংগ্রহ শুরু হয়। সংগ্রহ করা যাবে পরবর্তী ২৫ দিন। গ্লাডিওলাস ৫টি জাতসহ মোট ১২টি প্রজাতির ফুলের পরীক্ষা করে আমরা সফল হয়েছি।
জৈব
জৈব পদ্ধতিতে ফসলের রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ

সবুজ বিপ্লবের সময়ে পেস্টিসাইড ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীব বৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য ও ফসলের গুণমানতা। এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে, এত রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে? এ প্রশ্ন শুধু ভারতে নয়, সারাবিশ্বের কৃষকসমাজ ও শস্যবিজ্ঞানীদের কাছে। তাই মনে হয় জৈব নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে সুসংহত রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ আগামী দিনে একমাত্র সমাধানের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
চলমান খরিফ মরসুমে আমাদের রাজ্যে প্রধানত ধান, খরিফ পেঁয়াজ, জুট, ইক্ষু, তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়ে থাকে। এ রাজ্যে ধানে ঝলসা রোগের আক্রমণ একটি গুরুতর বিষয়।
জৈব পদ্ধতিতে এই রোগ দমন করার একটি সহজ উপায় রয়েছে। ৫০ মিলিলিটার কেরোসিন তেলে ৮৫ গ্রাম থেঁতলানো রসুন মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর ৯৫০ মিলি. জল ও ১০ মিলি. তরল সাবান মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিয়ে বোতলে রেখে দিতে হবে। ১৯ লিটার জলের সাথে ১ ভাগ মিশ্রণ মিশিয়ে সকালে/বিকেলে স্প্রেয়ার দিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
এই মিশ্রণটি আমেরিকান বোল ওয়ার্ম, আর্মি ওয়ার্ম, পেঁয়াজ-এর চিরুনি পোকা, আলুর টিউবার মথ, রুট নট নিমাটোড (কৃমি), আখের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ, ডাউনি মিলডিউ ও ধানের ঝলসা রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকরী।
এছাড়া বিভিন্ন ধরণের পাতা খেকো পোকা ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে ১ কেজি পেঁয়াজ থেঁতো করে ১ লিটার জলের সাথে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেবার পর কচলিয়ে রস নিংড়ে নিতে হবে। প্রাপ্ত নির্যাসের সাথে ১০ লিটার জল মিশিয়ে আক্রান্ত ফসলে স্প্রে করতে হবে।
জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রযুক্তিতে উৎপাদিত জৈব সার, শাকসব্জী ও অন্যান্য ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম-এর সাথে অণুখাদ্যের যোগান দেয়।
জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকগুলি ফসলে কোনওরকম দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ব্যতিরেকে, পোকা ও রোগ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও উর্বরতা দীর্ঘমেয়াদী হয়। উৎপাদিত ফসল হয় স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।
বন্ধুপোকা মাকড়ের (পরজীবি ও পরভোজী) সংরক্ষণের জন্য জমির পাশে অব্যবহৃত জায়গায় ত্রিধারা, উঁচুটি, শালিঞ্চে ইত্যাদি আগাছা জাতীয় গাছের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
দূরদর্শী পদক্ষেপের মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি বর্জন করে প্রাণ বৈচিত্র্য নির্ভর জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব আনা সম্ভব। তাই জৈব কৃষির পথে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কৃষিবিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয়।
এগ্রোবিজ
টি ব্যাগের ব্যবসা করে আয় করুন প্রচুর অর্থ

চা পানীয়টি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় একটি পানীয়। প্রিয়জনের সাথে বৈঠক থেকে শুরু করে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করা সবেতেই চা (Tea) আমাদের নিত্যসঙ্গী। তবে এখন মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশী স্বাস্থ্য সচেতন। সাধারণ চায়ের জায়গায় এসেছে, গ্রীণ টি, হার্বাল টি, লেমনগ্র্যাস টি, ব্লু টি ইত্যাদি। আর প্রকারভেদের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে টি ব্যাগের গুরুত্ব। কারণ এটি খুব অল্প সময়ে তৈরি করা যায় এবং যে কোন স্থানে এর থেকে চা বানানো যায়। অফিস ও হোটেলগুলিতে এর যথেষ্ট চাহিদাও রয়েছে। তাই টি ব্যাগ তৈরীর ব্যবসাটি হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্য লাভদায়ক।
চা উৎপাদনকারী দেশ গুলির মধ্যে অংশ নেয় চীন, ভারত , কেনিয়া , শ্রীলঙ্কা , জাপান , ইন্দোনেশিয়া , ভিয়েতনাম, তানজেনিয়া , মালয়, বাংলাদেশ, তার্কী এবং চা পানকারী দেশ গুলির মধ্যে ইংল্যান্ড, জর্মানী, কানাডা ও আমেরিকার বেশ নাম রয়েছে।
এ কারণে বেশিরভাগ সংস্থা টি ব্যাগ বিক্রি শুরু করেছে। আপনি যদি নতুন ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে আপনি টি ব্যাগ মেকিং ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এটির মাধ্যমে আপনি খুব ভাল অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। যিনি তৈরী করেন, তার থেকে নিয়ে এসে আপনি বাইরে বিক্রি করতে পারেন, এতে আপনার বিনিয়োগের দরকার পড়বে না। কিন্তু যদি বেশী লাভ করতে চান, তবে বিনিয়োগ করে নিজের ব্যবসা শুরু করুন।
টি ব্যাগ ব্যবসা শুরু করার জন্য জায়গা (How to start) –
এটি শুরু করার জন্য আপনি কোনও জায়গা ভাড়া নিতে পারেন। আপনার নিজের জমি থাকলে ব্যবসার জন্য সুবিধা হবে। এমন জায়গা চয়ন করুন, যেখানে মানুষের সমাগম রয়েছে। টি ব্যাগ তৈরীর জন্য আপনাকে মেশিন ইনস্টল করতে হবে।
চা ব্যাগ ব্যবসায় বিনিয়োগ –
আপনি যদি বড় আকারে ব্যবসা শুরু করতে চান, তবে আপনাকে বেশী অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এর মেশিনটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল, সুতরাং বেশী পরিমাণ রাশি বিনিয়োগের দরকার রয়েছে এই ব্যবসায়, তবে আপনি যদি ব্যাংক থেকে লোণ নেন, তবে আপনি ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
চা ব্যাগ তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল –
ফিল্টার পেপার –
এর ভিতরে চায়ের পাতা স্টোর করতে হবে। এই কাগজটি সুক্ষ ছিদ্রযুক্ত এবং পাতলা, পাশাপাশি সহজে ভিজে যায় না, তাই এই কাগজটি চা ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
চা পাতা –
আপনি যেমন প্রকারের ব্যাগ বিক্রি করতে চান, তেমন চা পাতা কিনতে হবে।
বিভিন্ন প্রকারের চা –
সাধারণ চা, গ্রীণ টি, উলং টি, ব্ল্যাক টি, হার্বাল টি
চা ব্যাগগুলিতে চা পাতা পূরণ করার প্রক্রিয়া –
চা ব্যাগ তৈরীর মেশিনের সাহায্যে প্রস্তুত চা পাতাগুলি ফিল্টার পেপারে পূরণ করতে হয়। সাধারণত প্রায় ২-৪ আউন্স চা পাতা একটি টি ব্যাগে ভরা হয়। এর পরে, একটি প্যাকিং মেশিনের সাহায্যে ব্যাগটি সিল করা হয়। টি ব্যাগের সাথে একটি সুতো সংযুক্ত থাকে।
চা ব্যাগ ব্যবসায় থেকে লাভ –
আপনি চায়ের পাতার গুণমান অনুযায়ী ব্যাগের দাম নির্ধারণ করতে পারেন। এই ব্যবসা থেকে খুব ভাল লাভ করা যায়। এর আরও বিক্রয়ের জন্য, আপনি বাজারে পাইকারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এগুলি ছাড়াও আপনি হোটেল বা অফিসের লোকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এই ব্যবসা আপনাকে মাসে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন দিতে পারে।
ছাদকৃষি
সহজ পদ্ধতিতে টবে করুন কদবেল চাষ

ছেলে থেকে বুড়ো সবারই প্রিয় টক ঝাল কদবেল। কদবেলের আচার, কদবেল মাখা সকলেরই অত্যন্ত পছন্দের। যারা বাগান করতে পছন্দ করেন, বিশেষত টবে, তাদের জন্য কদবেল এক আদর্শ ফল। কদবেলের আকার অনেকটা টেনিস বলের মতো। শরতের শুরুতে কদবেল বাজারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই ফলের মন মাতানো স্বাদ বিশেষ করে মহিলাদের ভীষণই পছন্দের।
টবে কদবেল চাষের পদ্ধতি (Farming Process)
মন কাড়া স্বাদের জন্য পাকা কদবেল সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। কদবেল গাছে ফুল আসে মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ। তবে ফল পাকতে সময় লাগে সেপ্টেম্বর-অক্টবর। টবে রোপনের জন্য কদবেলের কলমের চারা বেশি ভালো। কলমের চারা থেকে কয়েক বছরের মধ্যে ফুল-ফল ধরে। ছাদের টবে এই গাছের চাষ সহজেই করা যায়। জোড় কলম করে এর কলম তৈরি করা যায়। এ গাছের চাষাবাদ অনেকটা বেলের মতোই।
মাটি তৈরি (Land Preparation)
হাফ ড্রামে অথবা টবে পাঁচ সেন্টিমিটার পুরু করে ইটের খোয়া বিছিয়ে তার ওপর ১০ সেন্টিমিটার বালির স্তর দিতে হবে। ড্রামের তলার দিকে জল বার করে দেওয়ার জন্য ছিদ্র রাখতে হবে। এবার তিন ভাগ দো-আঁশ মাটির সাথে দুই ভাগ গোবর সার, ড্রামপ্রতি ২০০ গ্রাম এমওপি (পটাশ) সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি (ফসফেট) সার, ১ কেজি হাড়ের গুঁড়ো, ৫০ গ্রাম জিপসাম সার, ২০ গ্রাম ম্যাগেনেসিয়াম সালফেট (ম্যাগসাল) সার ও ১০ গ্রাম দস্তা সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ড্রামে বা টবে ভরে হালকা করে জল দিয়ে মাটি ভিজিয়ে এক থেকে দুই সপ্তাহ রেখে দিতে হবে।
ড্রাম বা টবের ঠিক মাঝখানে কদবেলের কলম বসিয়ে কলমের গোড়ার মাটি শক্ত করে চেপে দিতে হবে। কলম লাগানোর পর গাছের গোড়ায় জল দিতে হবে। সোজা ভাবে কলম রাখতে গেলে, গোড়ার কাছাকাছি কাঠি পুঁতে তার সাথে কলম বেঁধে দিলে ভালো। শীতকাল ছাড়া বছরের যেকোনও সময় কদবেলের কলম লাগানো যায়। ছাদের ওপর রোদের মধ্যে কদবেলের গাছ রাখা উচিত। এতে গাছের ভালোই হবে।
ফলন এবং পরিচর্যা (Caring)
কলমের গাছে ফুল ফাল্গুন-চৈত্র মাসে নাগাদ আসে। শরৎকালে ফল পেকে যায়। ডালপালা ফল সংগ্রহ করার সময় কিছু ছেঁটে দেওয়া উচিত। এর ফলে পরের বছর ফলন ভালো হবে। কদবেল গাছে ফুল-ফল ভালো আনার জন্য প্রতি বছর ফল তোলা শেষ হলে গাছের গোড়ার মাটিতে ড্রামপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ১০০ গ্রাম এমওপি সার, ১০০ গ্রাম টিএসপি সার দুই কেজি প্যাকেটের কম্পোস্ট সারের সাথে মিশিয়ে গোড়ার মাটি নিড়িয়ে তার সাথে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
গাছের বৃদ্ধি ভালো হলে বছরে একবার সার দিলে হবে না। বর্ষাকালের আগেও ঠিক একই ভাবে পুনরায় সার দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে টব বা ড্রামের মাটি যাতে না শুকিয়ে যায়। টবের মাটি কখনো শুকিয়ে গেলে নিয়ম করে সেচ দিয়ে নিতে হবে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন