ওয়ালডেমার হাফকিন: কলেরা ও প্লেগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পরও যার নাম ভুলে গেছে মানুষ
লেখক
বিবিসি বাংলাউনিশ শতকের শেষভাগে ওয়ালডেমার মোরডেকাই হাফকিন প্যারিস এবং ভারতে গবেষণা চালিয়ে কলেরা ও প্লেগ রোগের প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করেন। কিন্তু গণ-বিষক্রিয়ার এক ঘটনা তার জীবনকে তছনছ করে দেয়।আঠারোশো চুরানব্বই সালের বসন্তকাল।
ওয়ালডেমার হাফকিন হাজির হলেন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়। বসন্তকাল ছিল কলেরার মৌসুম। তিনি মনে করছিলেন, এ সময়টাতে তিনি শহরে কলেরার প্রকোপ দেখতে পাবেন।
এর আগের বছর মার্চ মাসে তিনি প্রথম ভারতে যান। তার সাথে ছিল এমন এক ভ্যাকসিন, যেটা দিয়ে তিনি আশা করছিলেন কলেরা প্রতিরোধ সম্ভব হবে। কিন্তু ভারতে পৌঁছানোর পর তিনি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হন।
ভারতের মাটিতে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই ব্রিটিশ ভারতের মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণ তার টিকা নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে, তার কাজে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। কারণ তিনি কোন ডাক্তার নন, তিনি ছিলেন একজন প্রাণীবিজ্ঞানী।
ওয়ালডেমার হাফকিন একজন রাশান ইহুদি, যিনি কাজ শুরু করেন ওডেসা শহরে। পরে প্যারিসে গিয়ে তিনি আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে সময়টাতে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে লোকের মনে ছিল ঘোর সন্দেহ।১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে কলকাতার বস্তিতে ওয়ালডেমার হাফকিন বাসিন্দাদের টিকা দিচ্ছেন
ওয়ালডেমার হাফকিন যখন ভারতে যান তখন তার বয়স ছিল ৩৩ বছর।
তার তৈরি নতুন টিকার পরীক্ষা নিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। এই ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ইনজেকশনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রথম ইনজেকশনের পর পরীক্ষায় যোগদান করা ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ইনজেকশন দিতে গিয়ে মি. হাফকিনের সহকর্মীরা সমস্যায় পড়ে যান। দ্বিতীয় টিকা নিতে আগ্রহী লোক আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
কলেরার প্রকোপ পুরো ভারত জুড়ে হলেও কোন একটি জায়গায় প্রকট আকারে দেখা পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন, মি. হাফকিন ওই বছর উত্তর ভারতে প্রায় ২৩,০০০ লোকের ওপর তার নতুন টিকা প্রয়োগ করেন।
এরপর তার নিজের লেখায় তিনি বলেন, “কিন্তু সে বছর সেখানে কোন কলেরাই দেখা যায়নি। ফলে এই নতুন টিকা আদৌ কাজ করছে কিনা, সেটা বোঝার কোন উপায় রইল না।”
কিন্তু ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে ওয়ালডেমার হাফকিনের সামনে নতুন একটি সুযোগ আসে।
কলকাতায় ব্রিটিশ ভারত সরকারের মেডিকেল অফিসার তাকে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। শহরের একটি বস্তির পুকুরে কলেরার ব্যাসিলাই জীবাণু রয়েছে কিনা, তা শনাক্ত করতে তাকে সাহায্য করতে হবে। বস্তিবাসী সব পরিবার ওই পুকুর থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করতো। ফলে তারা নিয়মিতভাবে কলেরায় আক্রান্ত হতো।প্যরিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউট, যেখানে হাফকিন ১৮৯২ সালে তার কলেরার টিকা উদ্ভাবন করেছিলেন
“যেটা অবাক করার মতো তা হলো – এবং যেটা প্রায়ই লোকে ভুলে যায় – যে প্রথম দিকে বাধা এলেও এক সময়ে মি. হাফকিনের কলেরা টিকা নেয়ার জন্য লোকে লাইন দিতে শুরু করেছিল,” বলছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও মেডিসিনের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক প্রতীক চক্রবর্তী।
“ভারতীয় ডাক্তারদের সাথে নিয়ে তিনি দিনরাত বস্তিতে বস্তিতে ঘুরতে শুরু করেন। বস্তির মজদুররা কাজে বেরুনোর আগে তিনি তাদের টিকা দিতেন। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময়েও তারা দেখতে পেত যে মি. হাফকিন তেলের বাতি জ্বালিয়ে বস্তিতে এক মনে কাজ করে যাচ্ছেন।”
কলকাতার বস্তিতে এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে মি. হাফকিন স্বল্প সংখ্যক বিজ্ঞানীদের একজনে পরিণত হন, যারা শিখেছিলেন বিশ্বব্যাপী মহামারিকে কীভাবে বুঝতে হয় আর কীভাবে এর মোকাবেলা করতে হয়।
কিন্তু তার আগে বসন্ত রোগের টিকা আবিষ্কারক ডা. এডওয়ার্ড জেনার কিংবা তারপরে পোলিও রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারক জোনাস সাল্ক’র মতো ওয়ালডেমার হাফকিন ভারতে কিংবা ইউরোপে তেমন একটা পরিচিতি পাননি।
“ওয়ালডেমার হাফকিন হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতের মতো কোন গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ল্যাবরেটরিতে তৈরি ওষুধ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন,” বলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। “তিনি ছিলেন প্যারিসের এক বিজ্ঞানী, যিনি হাজির হয়েছিলেন কলকাতার বস্তিতে। খুবই নাটকীয় ছিল তার কাহিনী।”
আঠারোশো চুরাশি সালে মি. হাফকিন যখন ওডেসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, তখন ওই বিভাগে শিক্ষক পদে তাকে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন একজন ইহুদি।
এর পাঁচ বছর আগে তিনি এক রাজনৈতিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। রুশ সেনাবাহিনীর ক্যাডেটরা স্থানীয় একজন ইহুদির ঘরদোর ভাঙচুর করার সময় তিনি বাধা দেন। তখন তাকে মারধর করা হয় এবং গ্রেফতার করা হয়। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
আঠারোশো আটাশি সালে ওয়ালডেমার হাফকিন দেশত্যাগ করে প্রথমে জেনেভায় যান এবং পরে প্যারিসে গিয়ে লুই পাস্তুর ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিয়ানের পদে যোগদান করেন। ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণায় এই ইন্সটিটিউট ছিল বিশ্ব সেরা।
কাজের অবসরে মি. হাফকিন হয় বেহালা বাজাতেন, নয়তো ব্যাকটেরিওলজি ল্যাবরেটরিতে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন।
পাস্তুর এবং জেনারের গবেষণার পথ ধরে তিনি দেখতে পান যে ল্যাবরেটরির গিনিপিগের দেহের মধ্যে প্রায় ৩৯ বার কলেরার জীবাণু ঢুকিয়ে বের করার পর জীবাণুর শক্তি বেড়ে যায়। এরপর তাপ প্রয়োগ করে ওই ব্যাকটেরিয়ার শক্তিকে কমিয়ে ফেলা যায়।
এরপর গিনিপিগের শরীরে একবার শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া আর একবার দুর্বল ব্যাকটেরিয়া ঢোকানোর পর গিনিপিগের দেহে এক ধরনের রোগ প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হয়, যা দিয়ে কলেরার প্রাণঘাতী জীবাণুকে প্রতিহত করা সম্ভব।কলকাতায় এ রকম বস্তিতে এক সময় দ্রুত হারে কলেরা ছড়িয়ে পড়তো – ছবিটি ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারীর যত ইতিহাস
মি. হাফকিনের কাছে তার নতুন তৈরি টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য এসব বস্তি ছিল আদর্শ এক জায়গা। বস্তির প্রতিটি বাড়ির অবস্থা একই রকম। বাসিন্দারা সবাই একইভাবে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন।
তিনি যদি প্রতিটি পরিবারের বাছাই করা কয়েক জনকে টিকা দেন এবং বাকিদের টিকা না দেন, তাহলে যথেষ্ট সংখ্যক পরিবারের ওপর তার এই পরীক্ষা থেকে একটা অর্থপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করছিলেন।
মার্চ মাসের শেষ নাগাদ কলকাতার কাঁঠালবাগান বস্তিতে দু’জন লোক কলেরায় আক্রান্ত হন। এটা ছিল নতুন প্রকোপের প্রথম ইঙ্গিত।
ওয়ালডেমার হাফকিন বস্তিতে চলে যান এবং বস্তির প্রায় ২০০ জন বাসিন্দার মধ্যে ১১৬ জনকে তার তৈরি টিকা দেন। তার টিম পরে লক্ষ্য করে যে বস্তির আরও ১০ জন কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এদের কাউকেই টিকা দেয়া হয়নি। এদের মধ্যে ১০ জন মারা যায়।
এই ফলাফলে আশান্বিত কলকাতার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও কয়েকটি জায়গায় এই নতুন টিকার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে টিকা নিতে রাজি করানো ছিল একটা কঠিন কাজ।
ভারতে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য সেবা ছিল জোর করে চাপিয়ে দেয়ার এক ব্যবস্থা। এর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল কম। আর টিকা জিনিসটা সম্পর্কেই মানুষের কোন ধারণা ছিল না।
এই সমস্যা সমাধানে মি. হাফকিন একটা কৌশল বের করলেন। তিনি ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারদের বাদ দিয়ে ডা. চৌধুরী, ডা. ঘোষ, ডা. চ্যাটার্জি এবং ডা. দত্তদের মতো ভারতীয়দের সাথে নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
তিরি আরও একটা কৌশল তৈরি করলেন: সেটা হলো, তার উদ্ভাবিত টিকা জনসমক্ষে তিনি নিজের দেহে প্রয়োগ করলেন। উদ্দেশ্য: দেখানো যে এটা নিরাপদ।১৮৯০ সালে তোলাতখনকার দিনে লোকে মনে করতো কলেরার মতো রোগ তৈরি হয় বিষাক্ত বাষ্প থেকে।
অধ্যাপক চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, আর এসব রোগের চিকিৎসার জন্য ছিল নানা পদ্ধতি। যেমন: রোগীকে বাথটাবে ডুবিয়ে তার ওপর গরম পানির বাষ্প ছাড়া হতো যতক্ষণ পর্যন্ত রোগী অবস্থা মরো মরো না হয়। কিংবা সব জায়গায় কার্বলিক অ্যাসিড ছিটিয়ে দেয়া হতো।
কিন্তু ওয়ালডেমার হাফকিন ও অন্যান্যদের গবেষণার মধ্য দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার এক নতুন কায়দা আবিষ্কৃত হয়। সেটা হলো: ল্যাবরেটরিতে তৈরি শক্তিশালী ও দুর্বল ব্যাকটেরিয়া রোগীর দেহে প্রবেশ করিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এবং প্রাণঘাতী জীবাণুকে পরাস্ত করা।
প্যারিসে গিনিপিগের ওপর পরীক্ষার সাফল্যের পর মি. হাফকিন খরগোশ এবং কবুতরের ওপর একই ধরনের পরীক্ষা চালান। এবার তার কাজ হবে মানবদেহে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানো।
১৮৯২ সালের ১৮ই জুলাই তিনি ইনজেকশন দিয়ে নিজের দেহে দুর্বল ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করান। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। পরে অবশ্য সেরে ওঠেন।
এরপর তিনি কয়েকজন রুশ বন্ধু এবং কয়েকজন ভলান্টিয়ারের ওপরও তার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন। কিন্তু তাদের দেহে কোন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন তার ভ্যাকসিনটি এখন আরও বড় পরিসরে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু বড় সংখ্যায় লোকের ওপর এই পরীক্ষার জন্য তার প্রয়োজন ছিল এমন একটি দেশ যেখানে প্রতি বছর কলেরার মহামারি হয়। ১৮৯৩ সালে প্যারিসে তখনকার ব্রিটিশ দূত এবং এক সময়ে ভারতের বড়লাট লর্ড ফ্রেডরিক ডাফরিন ওয়ালডেমার হাফকিনের কথা জানতে পারেন এবং তাকে বাংলায় গিয়ে পরীক্ষা চালানোর পরামর্শ দেন।ওয়ালডেমার হাফকিন বোম্বাইয়ের এই হাসপাতালেই স্থাপন করেন তার প্লেগ ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণাগার
যে বছর মি. হাফকিন কলকাতার বস্তিতে তার সফল পরীক্ষা চালান, তার পরের বছর আসামের চা বাগানের মালিকরা তাকে আমন্ত্রণ জানান সেখানে গিয়ে বাগানের শ্রমিকদের ওপর তার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে। তিনি সেখানে হাজার হাজার শ্রমিককে টিকা দেন।
কিন্তু ১৮৯৫ সালের শরৎকালে তিনি নিজেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ডে যান। তার নিজের হিসেব অনুযায়ী, ততদিন পর্যন্ত তিনি ৪২,০০০ লোককে তিনি কলেরার টিকা দিয়েছিলেন।
মি. হাফকিন লক্ষ্য করলেন, তার তৈরি টিকায় রোগীর সংখ্যা কমে এলেও মৃত্যুর হার কমাতে পারছে না। ১৮৯৬ সালে তিনি যখন ভারতে ফিরে আসেন তখন এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি দুটো কৌশল অবলম্বনের চিন্তা করেন।
কিন্তু তখন বোম্বাই শহরে দেখা দিয়েছিল নতুন এক বিপদ। আর সেটাই ওয়ালডেমার হাফকিনের জন্য কলেরার গবেষণার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিল।
প্লেগ রোগের বিশ্বব্যাপী তৃতীয় মহামারিটি শুরু হয়েছিল ১৮৯৪ সালে চীনের ইউনান শহর থেকে। সেখান থেকে এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। হংকং সে সময় ছিল ব্রিটেনের শাসনাধীন। এই মহামারি ওই শহরে পৌঁছায় এবং বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে প্লেগ এসে হাজির হয় ভারতের বোম্বাই শহরে।
প্রথম কেসটি ধরা পড়ে ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জাহাজঘাটার কাছে এক চালের আড়তদারের বাড়িতে প্লেগ রোগ দেখা দেয়।
প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার এই মহামারির তীব্রতাকে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। কারণ তারা চাইছিল বন্দর নগরীর কাজকর্মের ওপর যেন মহামারির কোন প্রভাব না পড়ে। কিন্তু প্লেগ আগুনের মতো বোম্বাইয়ের ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রোগে মৃত্যুর হার কলেরা মহামারিতে মৃত্যুর হারের প্রায় দ্বিগুণ। ফলে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ঠিক এই সময়টাতে ব্রিটিশ সরকার ওয়ালডেমার হাফকিনের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠায়।প্লেগ রোগের প্রশমনে পুজা চলছে
মি. হাফকিন বোম্বাইতে যান। সেখানে গিয়ে ল্যাবরেটরির জন্য ছোট একটি ঘর, একজন কেরানি এবং তিনজন প্রশিক্ষণহীন সহকারীকে নিয়ে শুরু করেন প্লেগ রোগের প্রথম ভ্যাকসিন তৈরির কাজ।
“তার জায়গা ছিল কম, লোকবল ছিল কম, সুযোগ-সুবিধেও খুব একটা ছিল না। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছিলেন এবং তার নিজস্ব একটি ল্যাবরেটরি ছিল,” বলছিলেন দিল্লির একজন রোগত্ত্ববিদ চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া।
“তিনি জানতেন তিনি যদি রেকর্ড সময়ের মধ্যে প্লেগ-এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে তিনি হবেন সেই সময়কার সেরা বিজ্ঞানী।”
সেই বছর পুরো শীতকাল জুড়ে মি. হাফকিন কঠোর পরিশ্রম করেন। ডিসেম্বর মাসে তিনি খরগোশের ওপর তার টিকা ব্যবহার করে আশানুরূপ ফল লাভ করেন। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে তিনি তার নতুন ভ্যাকসিন মানবদেহের ওপর পরীক্ষার জন্য তৈরি হলেন।
দশই জানুয়ারি তিনি নিজে ১০ সিসি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলেন। এটা ছিল মাপের দিক থেকে বেশি। কারণ তিনি মানুষের ওপর পরীক্ষায় মাত্র তিন সিসি ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকল্পনা করছিলেন।
এর জেরে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি জ্বরে পড়ে থাকার পর তিনি আবার ভাল হয়ে ওঠেন।
ওই মাসের শেষ নাগাদ বোম্বাইয়ের বাইকুলা জেলে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। মি. হাফকিন সেখানে গিয়ে বন্দিদের ওপর সীমিত আকারে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানোর অনুমতি পান।
তিনি ১৪৭ জন বন্দীকে টিকা দেন। অন্য ১৭২ জনকে টিকা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দেখা যায় যাদের টিকা দেয়া হয়নি তাদের মধ্যে ১২ জনের প্লেগ হয় এবং এদের মধ্যে ছয়জন মারা যায়। অন্যদিকে, যাদের টিকা দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দু’জনের প্লেগ হয় এবং এদের কেউই মারা যায়নি।বোম্বাইয়ে জামশেদজী বন্দর হাসপাতালে প্লেগ আক্রান্ত শিশুর পাশে মা
বাইকুলা কারাগারে পরীক্ষায় এই সাফল্যের পর ভ্যাকসিন উৎপাদনে গতি বৃদ্ধি হয়।
মি. হাফকিনকে তার ছোট্ট অফিস থেকে সরিয়ে সরকারের একটি বিশাল বাংলো দেয়া হয়। বোম্বাইয়ের ইসমাইলিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান আগা খান পরে তাকে একটি বিশাল বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে আসেন। আগা খান নিজে এবং খোজা মুসলমান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় এই টিকা নেন।
পরবর্তী এক বছরে লক্ষ লক্ষ মানুষ মি. হাফকিনের তৈরি টিকা নেন। অসংখ্য লোকের জীবন রক্ষা হয়। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া তাকে সম্মানসূচক নাইট উপাধি দেন।
এরপর ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে ওয়ালডেমার হাফকিনকে বোম্বাইয়ের পারেল-এর সরকারি প্লেগ গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য পরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। এই নতুন গবেষণাগারে ছিল নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধে আর ছিল ৫৩ জন কর্মচারী।
আর ঠিক তখনই ঘটে বিপর্যয়।
উনিশশো দুই সালের মার্চ মাসে মি. হাফকিনের টিকা নেয়ার পর পাঞ্জাবের মালকোয়াল গ্রামে ১৯ জন ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। একই গ্রামের আরও ৮৮ জনকে টিকা দেয়া হলেও তাদের কিছু হয়নি।
যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে পারেল গবেষণাগারে ৪১ দিন আগে তৈরি একটি বিশেষ বোতলের ভ্যাকসিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এ নিয়ে ভারত সরকারের একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। তারা দেখতে পায় যে বোতল শুদ্ধি করার জন্য কার্বলিক অ্যাসিড ব্যবহার না করে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তা বিশুদ্ধ করা হয়েছিল। আর এটা করা হয়েছিল মি. হাফকিনের নির্দেশে। কারণ, এইভাবে বেশি সংখ্যক বোতল দ্রুততম সময়ে বিশুদ্ধ করা যেত।
এই তাপমাত্রা প্রয়োগের পদ্ধতি তার দু’বছর আগে থেকেই বিশ্বখ্যাত লুই পাস্তুর ইন্সটিটিউটে ব্যবহার হয়ে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের তা অজানা ছিল।
এই তদন্তের পর মি. হাফকিনকে প্লেগ গবেষণাগারের প্রধানের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিস থেকে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।বোম্বাইতে প্লেগ রোগীর খোঁজে বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি
সরকারের এই পদক্ষেপে লাঞ্ছিত হয়ে মি. হাফকিন ভারত ত্যাগ করেন এবং লন্ডনে চলে যান। দ্রুততম সময়ে প্লেগ-এর টিকা আবিষ্কার এবং মহারানীর খেতাব পাওয়ার পরও ওয়ালডেমার হাফকিন টের পান যে তিনি আসলেই বাইরের লোক।
তবে এই অভিজ্ঞতা তার জন্য একেবারেই নতুন ছিল না।
“সেই জামানায় নানা ধরনের পক্ষপাত কাজ করতো। নানা ধরনের বৈষম্য কাজ করতো,” বলছেন ড. বারবারা হগুড, যিনি ওয়ালডেমার হাফকিনের কর্ম ও জীবন সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন।
“তিনি যেহেতু মেডিসিনের ডাক্তার ছিলেন না, তাই তিনি হলেন বাইরের লোক। অনেক ধরনের অহমিকাও তখন কাজ করতো।”
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক এলি শারনিন মি. হাফকিনের চিঠিপত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “মি. হাফকিন ইহুদি-বিরোধী মনোভাবের শিকার হয়েছিলেন কাগজপত্র দেখে একথা প্রমাণ করা না গেলেও তিনি যে ইহুদি এবং সেটা দ্বারা ব্রিটেনের তৎকালীন এডওয়ার্ডিয়ান প্রশাসন ব্যবস্থা মোটেও প্রভাবিত ছিল না, এটা সরল মনে বিশ্বাস করাও কঠিন।”
সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার দু’বছর পর ১৯০৪ সালে ভারতে প্লেগের প্রকোপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং তাতে ১১ কোটি ৪৩ লক্ষ ৯৯৩ জন মারা যায়। এই লড়াইয়ে মি. হাফকিনের ভ্যাকসিনই ছিল প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু এর আবিষ্কারক তখন লন্ডনে নিজের সুনাম রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
মালকোয়ালের দুর্ঘটনার চার বছর পর সরকার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং মি. হাফকিনকেই দোষী সাব্যস্ত করে।
প্রতিবেদনের দলিল-দস্তাবেজ ঘাটাঘাটি করে লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ডাব্লু. জে. সিম্পসন ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে লেখা এক চিঠিতে যুক্তি তুলে ধরেন যে ভ্যাকসিনের বোতলটি পারেল গবেষণাগারে নষ্ট হয়নি। সেটি নষ্ট হয়েছিল পাঞ্জাবের গ্রামে যেখানে টিকা কর্মসূচি চলছিল।
এই চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর ওয়ালডেমার হাফকিনের প্রতি ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের সমর্থন বাড়তে থাকে। ম্যালেরিয়া যে একটি মশা-বাহিত রোগ একথা প্রমাণ করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ডা. রোনাল্ড রস। তিনি লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় চারটি কঠোর চিঠি লিখে ব্রিটিশ জাতির বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে অবহেলা করার অভিযোগ করেন।
তিনি লেখেন, যতদিন পর্যন্ত ওয়ালডেমার হাফকিনের বিরুদ্ধে রায় বদলে দেয়া না হবে ততদিন পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ সরকার “তার একজন শীর্ষ উপকারীর বদান্যতার প্রতি অকৃতজ্ঞ বলেই বিবেচিত হতে থাকবে।”
রোনাল্ড রস সে সময় আরেকটি ভবিষ্যতবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যা আজকের দিনেও প্রযোজ্য।
তিনি বলেছিলেন, যে সময়ে প্রতি সপ্তাহে ৫০,০০০ মানুষ প্লেগ রোগে মারা যাচ্ছে, সেই সময়ে যদি মিথ্যে প্রচার করা হয় যে গবেষণাগারে তৈরি ভ্যাকসিন দূষিত তাহলে যে কোন ভ্যাকসিনের ওপর থেকেই মানুষের আস্থা চলে যাবে।বোম্বাইয়ে প্লেগ আক্রান্ত বাড়ির বাইরে চুনকাম চলছে
সরকারের এই অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লেখালেখির জেরে বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯০৭ সালের নভেম্বর মাসে ওয়ালডেমার হাফকিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করা হয়। তাকে ভারতে তার কাজে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয়।
তিনি খুশি মনেই তার নতুন কাজের জায়গা ক্যালকাটা বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির পরিচালকের পদে যোগদান করেন।
কিন্তু তার দায়মুক্তি ছিল অসম্পূর্ণ। তিনি তার গবেষণায় কোন ধরনের প্রয়োগ করতে পারতেন। তাকে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
“মালকোয়ালের ঘটনার অন্যায় শাস্তি এখনও আমার ওপর বহাল রয়েছে,” এক চিঠিতে তিনি স্যার রোনাল্ড রসের কাছে লিখেছিলেন। “প্রতি মুহূর্তে লিখিতভাবে কিংবা মৌখিক বক্তব্যে এটা বার বার করে উল্লেখ করা হয় এবং মনে করিয়ে দেয়া হয় যে ওই ঘটনার জন্য আমি আগেও দায়ী ছিলাম এবং এখন দায়ী আছি।”
পরবর্তী সাত বছর ছিল ওয়ালডেমার হাফকিনের জন্য নিষ্ফল এক সময়।
তার জীবদ্দশায় তিনি ৩০টির মতো গবেষণাপত্র লিখলেও, ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে তার গবেষণাপত্র ছাপা হয় মাত্র একটি। ১৯১৪ সালে ৫৫ বছর বয়সে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। এবং চিরদিনের জন্য ভারত ত্যাগ করেন।
মালকোয়ালের বিপর্যয় তার জীবনে যে কালিমা লেপে দিয়েছিল তা কখনই মুছে যায়নি। আর সেই ক্ষত রয়ে যায় সারা জীবন।১৮৯৭ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে বোম্বাই থেকে দুই কোটি ৬০ লক্ষ ডোজ প্লেগের ভ্যাকসিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়।
হাফকিন গবেষক বারবারা হউড লিখেছেন, এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছিল ৫০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ। কিন্তু ওয়ালডেমার হাফকিনের এই ভ্যাকসিন “কত মানুষের জীবন রক্ষা করেছে তার কোন হিসেব নেই।”
“এটা নিশ্চয়ই বিশাল এক সংখ্যা,” মনে করেন তিনি।
ভারত থেকে ওয়ালডেমার হাফকিন চলে যান প্যারিসে। সেখানে তিনি পূর্ব ইউরোপে ইহুদিদের শিক্ষার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কখনও বিয়ে করেননি। তার শেষ জীবন কাটে সু্ইটজ্যারল্যান্ডের লুজান শহরে। ১৯৩০ সালে ৭০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যে দুই কামরার ল্যাবরেটরি থেকে ওয়ালডেমার হাফকিন প্লেগের ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন সেটি এখন মুম্বাইয়ের কেপিএম হাসপাতালের অংশ। ওই আবিষ্কারের একশো’ বছরেরও বেশি সময়র পর এই হাসপাতালটি আরেকটি মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুরোভাগে রয়েছে। সেটি হলো নভেল করোনাভাইরাস।
“করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কেপিএম যে প্রথম কাতারে থেকে লড়ছে, এটা তার প্রতি একটা শ্রদ্ধার প্রতীক,” বলছেন দিল্লির রোগত্ত্ববিদ চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া।
“বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করতে তিনি বহু বিজ্ঞানীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু কোন কারণে সবাই তার নাম ভুলে গেছে। আমাদের মনে রাখা উচিত যে দুই কামরার ছোট্ট একটি ল্যাব থেকে খুবই অল্প সংখ্যক সহকর্মী নিয়ে তিনি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করতে পেরেছিলেন। এটা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার।”
তবে একদিক থেকে ওয়ালডেমার হাফকিনের নাম একেবারে মুছে যায়নি।
তার মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে ১৯২৫ সালে তার সমর্থক ও অনুসারীরা ভারত সরকারের কাছে আর্জি জানায় যে বোম্বাইয়ের পারেল গবেষণাগারের নাম পাল্টে “দ্যা হাফকিন ইন্সটিটিউট” রাখা হোক। সরকার এতে রাজি হয় ।
সেই থেকে ওয়ালডেমার হাফকিনের নামটি এখনও জীবিত রয়ে গেছে।
-
ওয়ালডেমার হাফকিন: কলেরা ও প্লেগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পরও যার নাম ভুলে গেছে মানুষ
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-

আপনার জন্য নির্বাচিত সংবাদ
-
এবার দেশে চীন-ভারতের নতুন টিকার পরীক্ষা
-
দ্রুত টিকা আনার চেষ্টা চলছে, আগে পাবেন সম্মুখযোদ্ধারা: প্রধানমন্ত্রী
-
খাতা-কলম ও মাঠের চিত্রে ‘মিলছে না’ চাল উৎপাদনের হিসাব
-
রাবার তৈরি হয় যেভাবে
-
ঘন কুয়াশায় রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা
-
যেভাবে ঘরে বসে মাশরুম চাষ করবেন
-
ইউটিউব দেখে ক্যাপসিক্যাম চাষে চমকে দিলেন নাহিদ
-
ক্যাপসিকাম চাষে ৪ লাখ টাকা আয়ের আশা
-
নিষিদ্ধ সত্ত্বেও সর্বোচ্চ মুনাফা টিকটকের
-
স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করবে অ্যাপল ও হুন্দাই

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে সরকার
কৃষি বিভাগের দাবি, চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। লাগামহীন চালের দাম দুর্ভোগে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। তাই চাল উৎপাদনের তথ্য নিয়ে ‘প্রশ্ন’ উঠেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলে কেন চাল আমদানিতে যেতে হচ্ছে? মাঠ পর্যায় থেকে ফসল উৎপাদনের সঠিক চিত্র আসছে না বলে সম্প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাঠ পর্যায় থেকে নমুনা নিয়ে তারা উৎপাদনের তথ্য দেন। যদিও লোকবলের সংকট আছে। করোনাভাইরাসের কারণে তারা এবার মাঠ পর্যায়ে সেভাবে যেতে পারেননি। চালের চাহিদার তথ্য সঠিক না হলে প্রকৃত উৎপাদনের তথ্য দিয়েও সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
গত বছরের আগস্টে চালের মজুত নিয়ে এক সেমিনারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) পূর্বাভাস দিয়েছিল, চাহিদা মেটানোর পরও সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। নভেম্বরের (২০২০ সালের) মধ্যে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হলে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কায় থাকবে না।

পরে ডিসেম্বরে ব্রি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণ করেও আগামী বছরের (২০২১) জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। একই সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও (বিবিএস) উৎপাদনের তথ্য দেয়।
চলতি মৌসুমে এক কোটি ৫৬ লাখ টন আমন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু এবার আমনের ভর মৌসুমে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ৫০ টাকায় পৌঁছেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে ।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় বলেন আর বিসিএস-ই বলেন, তারা প্রতি জেলায় ৫ কাঠা, ১০ কাঠার ডেমোনেস্ট্রেশন (প্রদর্শন) ফার্ম করেন, প্লট করেন। সেই প্লটে যে প্রোডাকশন হয়, এর ওপরই তারা হিসাব দিয়ে দেয়। এই হিসাবে তো আমাদের চলবে না।’
উৎপাদনের যে হিসাব আসছে তা সঠিক কি-না, এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তা জোর গলায় বলব না। সেটা এগ্রিকালচার ও বিসিএসই বলুক।’

মাঠ প্রশাসন থেকে চাল উৎপাদনের সঠিক তথ্য না দেয়ার অভিযোগ
গত ৭ জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মাঠ প্রশাসন থেকে চাল উৎপাদনের বিষয়ে সরকারকে সঠিক তথ্য না দেয়ার অভিযোগ ওঠে। অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের কারণে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে বলে জানান স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ময়মনসিংহ-৯ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আবেদীন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত মিটিংয়ে এটা (উৎপাদনের ত্রুটিপূর্ণ তথ্য) নিয়ে কথা হয়েছে। মাঠ থেকে যে তথ্য আসে সেই তথ্যের সাথে বাস্তবের অমিল খুঁজে পেয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ কারণে কমিটির সভাপতি (মতিয়া চৌধুরী) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বাস্তব ও মাঠের চিত্রের মধ্যে অনেক অমিল, এটা ঠিক রাখার চেষ্টা করুন। এত চাল উদ্বৃত্তের কথা যদি আপনারা বলেন, তবে সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে কেন? পরবর্তী সময় এটা যাতে আর না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন তিনি (সভাপতি)।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমিও মনে করি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ যারা আছে তারা আসলে উৎপাদনের বিষয়ে সঠিক তথ্য দেয়নি। উদ্বৃত্তের কথা বলা হচ্ছে আবার কিনতে হচ্ছে, কথা তো দিনরাত তফাৎ হয়ে গেল! এ বিষয়টি এবার ধরা পড়ল।’

অনেক ব্যবসায়ী লাভের আশায় ধান ধরে রাখছেন
উৎপাদনের তথ্যের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের জনবল সঙ্কট রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা সঠিক হিসাব দেয়ার চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমনের উৎপাদনের হিসাব এখনও আমরা চূড়ান্ত করিনি। ফসল কাটা এখনও শেষ হয়নি। এবার উৎপাদন তো কম হবেই, বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে– এটা তো আমরা বলেছি। এক লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এবার আমনে এক কোটি ৪০ থেকে ৪২ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের হিসাবের পর আবার বিসিএসের সঙ্গে মিলিয়ে থাকি।’
মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা একভাবে রিপোর্ট তৈরি করি, বিবিএস আরেকভাবে করে। আমাদের স্যাম্পল (নমুনা) নেয়ার পরিমাণ বেশি, কারণ আমাদের মাঠ পর্যায়ে লোক আছে। স্যাম্পল বেশি নেয়ার কারণে আমাদের হিসাবটা যুক্তিসঙ্গত মনে করি।’
আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এই (উৎপাদনের হিসাব) প্রক্রিয়াটায় আরও কাজ করব। যাতে আরও বেশি স্যাম্পল নিয়ে অ্যাভারেজ (গড়) করে উৎপাদনের হিসাবটা দিতে পারি।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘উৎপাদন বেশি হলেই যে চালের দাম বাড়বে না, এমন তো কোনো কথা নেই। মজুত করেও তো দাম বাড়ানো যায়। মজুতের মাধ্যমে বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যাবে। অনেকে লাভের আশায় ধান ধরে রাখছেন। এটা তো একটা ফ্যাক্ট।’

চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় আমদানি নিয়ে প্রশ্ন
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উৎপাদনের হিসাবের প্রক্রিয়া তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘নমুনা হিসেবে কিছু কৃষকের সঙ্গে কথা বলি– এক বিঘা জমিতে কত মণ ধান হয়েছে। আমরা ১০-১২ জন মানুষ আমাদের পক্ষে তো সারাদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। যাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি তারা যদি ভুল তথ্য দেয় সেটা ধরা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে তথ্য নেই। কোথাও ফোনে কথা বলি। আমরা কোনো কোনো স্থানে ধান কেটে মেপে, ময়েশ্চার অ্যাডজাস্ট করে হিসাব করি। এবার করোনার কারণে তো মাঠ পর্যায়ে যাওয়া যায়নি, অনলাইনে কাজ করতে হয়েছে।’
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জনসংখ্যা যেটা ধরে হিসাব করি, প্রকৃত সংখ্যা সেটার থেকে বেশি হলেও সমস্যা থাকবে, হিসাব মেলানো যাবে না। এবার আমনের উৎপাদন কম হয়েছে এটা সরকার স্বীকৃত। ১০ শতাংশ কম হলেও ১৫ লাখ টন কম হবে। যেটুকু নষ্ট হয় তা বাদ দিলেও তো খাদ্যের অভাব হওয়ার কথা নয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন প্রতিজন ৩৬৭ গ্রাম চাল খায়। করোনার কারণে অনেক মানুষ বিদেশ থেকে এসেছে। তারা খাচ্ছে। জনসংখ্যার হিসাব অনেক দিন আগের। হিসাব ঠিকঠাক থাকলে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন খাবার উদ্বৃত্ত থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

শেখ আনোয়ার
রাবারের ব্যাপারে মানুষ শুরু থেকেই উৎসুক ছিল। কারণ রাবার হলো ওয়াটার প্রুফ। পানি চোয়ায় না। টেনে লম্বা করা যায়। তাপে গলিয়ে যে কোনো আকৃতিতে পরিণত করা সম্ভব। প্রথমদিকে রাবার ব্যবহারে কতগুলো মৌলিক অসুবিধা ছিল। যেমন- ঠান্ডা আবহাওয়ায় রাবার শক্ত হয়ে সংকুচিত হয়। আবার গরমে গলে নরম আঠালো হয়ে যায়।
রাবার থেকে তৈরি জিনিস ২৪ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা যেত না। হাজার হাজার বছর ধরে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ বিভিন্ন আকারের রাবারের জিনিস তৈরি করতো। এর মধ্যে ছিল জুতা, বল, পানি ধারক পিপাসা নিবারনী আলখাল্লা ইত্যাদি।
রাবার পাওয়া যায়, রাবার গাছের রস থেকে। এ রস দেখতে সাদা। একদম দুধের মতো। রাবার গাছের সাদা কষ রাবারের মূল উপাদান। রাবারের এ কষকে বলা হয় সাদা সোনা। রাবার গাছ জন্মে পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ভাটেরা, সাতগাঁও শাহজীবাজার ও রূপাইছড়া রাবার বাগান রয়েছে। রাবার গাছের কাণ্ড চেছে কাঠের অংশটি ছিলে দেয়া হয়। সেই চাছা অংশ থেকে রস টপ টপ করে পড়তে থাকে। দেখা যায় যে, চাছা অংশে যদি একটি কাঠি পুতে দেয়া হয়, তবে রস ফোঁটায় ফোঁটায় পরতে থাকে। রস এভাবে সংগ্রহ করাটিই উত্তম।

রাবার আবিষ্কার হওয়ার পর এবং তরল রাবারকে শক্ত করার পদ্ধতিও বের করে মানুষ। এদিকে শক্ত রাবারকে ইউরোপীয়রা পুনরায় তরলে পরিণত করার একটি উপায়ের কথা ভাবতে শুরু করে। ক’দিন আগেও ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট আলোকিত করার জন্য ব্যবহার করা হতো কয়লা গ্যাস। এর প্রধান উপজাত হলো ন্যাফথা।
ন্যাফতা শক্ত রাবারকে গলে দেয় এবং রাবারকে তরল করে। চার্লস স্যাকিনটোল দু’টুকরো কাপড়ের মাঝখানে তরল রাবারের দ্রবণ সেটে সে সময় সুন্দর রেইনকোট বানান। যদিও এই রেইনকোট খুব ভারি এবং শক্ত ছিলো। তবে এটিই হলো পৃথিবীর প্রথম রেইনকোট বা বর্ষাতি।
এই সময় লন্ডনে, টমাস হ্যানকক দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কিছু রাবার সংগ্রহ করেন। সে রাবার দিয়ে তিনি রাবার ব্যান্ড, দস্তানা, বুট জুতা ইত্যদির সম্প্রসারণ (ইলাস্টিক) অংশগুলো তৈরি করেন। তবে রাবার তাপে গরম করলে বা পুনরায় তরল করলে আগের যে শক্তি তা নষ্ট হয়ে যেতো এবং বিকৃত হতো তাড়াতাড়ি।

তাই রাবারকে অনেককাল পর্যন্ত নানাভাবে রদবদল করলেও কি করে শক্ত, মজবুত, মসৃণ, সম্প্রসারণশীল, আঠালো, অর্থাৎ এর স্বাভাবিক গুণাবলী অক্ষুণ্ন রাখা যায় এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হলো।
আমেরিকায় ওভারশু প্রচলন হবার পর আমাজানের ভারতীয়রা ওইসব ওভারশু তৈরি করে রফতানি করতো। খুব শিগগিরই পানি নিরোধী কোট, জীবন রক্ষাকারী টিউব, ওয়াগনের ঢাকনা, হোস পাইপ ইত্যাদিও রাবার দিয়ে তৈরি শুরু হলো। বাজার ছেয়ে গেলো রাবারের জিনিসে। তবে রাবার শক্ত হওয়া, আঠালো, চটচটে, বিশ্রী গন্ধ ইত্যাদি সমস্যা কিন্তু তখনো ছিলো।
গরম ঠান্ডায় রাবারের দোষগুলো কাটিয়ে নেয়ার উপায় বের করার চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে নানানজন করেছেন। চার্লস গুডইয়ার হলেন এদের মধ্যে সবচে সার্থক। গুডইয়ারের কথা বলবার আগে অন্যান্যদের কথা কিছু বলে নেয়া উচিত।

চার্লস গুডইয়ার নিউইয়র্কের এক দোকানে একদিন রাবারের তৈরি লাইফ প্রিজারভার দেখেন। জিনিসটি তার খুব ভালো লাগলো। এটি আরো উন্নত করার জন্য উন্নতমানের একটি ভাল্ব তৈরি করে দোকানদারকে দেন। গুডইয়ারের আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। ভেবেছিলেন এ থেকে কিছু পয়সা পাবেন। কিন্তু দোকানদার গুডইয়ারকে বললো, রাবারই ভালো নয়, তো ভালো ভাল্ব দিয়ে কি হবে?
সেই থেকে শুরু। গুডইয়ার রাবার স্বাভাবিক গুণাবলি অক্ষুণ্ন রাখার কৌশল আবিষ্কারে মনোনিবেশ করলেন। রসায়নের কোনো জ্ঞান তার নেই। যন্ত্রপাতি সমন্ধেও কোনো ধারণা নেই। সবচে বেশি যা দরকার- টাকা। তাও নেই তার। তবু চললো গবেষণা।

পরবর্তী পাঁচ বছরে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। নানা রকম বাঁধা বিপত্তির পর নিজের একক প্রচেষ্টায় রাবার সমস্যার সমাধান করলেন। নিজের আবিষ্কারকে বললেন, মেটালিক গাম ইলাস্টিক। এটিই পরবর্তীকালে ভলকানাইজেশন নামে পরিচিত হয়। অগ্নিদেবতার নাম ভলকান। তার থেকেই এই নামের উৎপত্তি।
ভলকানাইজিং আবিষ্কার হবার পর রাবার থেকে বুট জুতা, কাপড়, ডাক্তারি যন্ত্রপাতি, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ইত্যাদিসহ গাড়ির টায়ার সবই তৈরি সহজ হয়ে গেলো। সেই থেকে শুরু। এখনো গুডইয়ারের ভলকানইজড রাবার সেরা রাবার হিসেবে বিখ্যাত।

রবি মৌসুমে যেভাবে ঘন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে তাতে রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা। ঘন কুয়াশা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে রবি শস্য বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বলে ধারণা করছেন তারা।
সদর উপজেলা কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে এ আবহাওয়ার কারণে বোরো ধানের চারা হলদে রং হয়ে যাবে।
সরিষা, টমেটো ও আলু খেতে লেট রাইট রোগের প্রকোপ বাড়বে। শাক-সবজির সাধারণ বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। আম ও কুল গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে যাবে। কারণ কুয়াশায় সবুজ পাতার স্ট্রোমা ছিদ্র হয়ে যায়।
এতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। কুয়াশার কারণে আমের মুকুলে এনথ্রাক্স ও পাউডারি মিলভিউ রোগ দেখা যায় এবং পাউডারি মিলভিউ রোগে মুকুল পচে যায়।

এছাড়া আম গাছের হোপার পোকার আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। এধরনের আবহাওয়া অব্যাহত থাকলে কুলেও এনথ্রাক্স রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগে কুলের বহিরাবরণে কালো দাগের সৃষ্টি হবে এবং এক সময় কুল পচে যাবে।
কৃষিবিদ কামরুন্নাহার তামান্না জানান, ঘন কুয়াশার কারণে ঘটিত রোগ প্রতিরোধে টমেটো, আলু ও শীতকালীন লতা সবজিতে রেডোমিন গোল্ড স্প্রে করে দিতে হবে।
আমের মুকুল ও কুল ফসলে ভালো করে পানি স্প্রে করে দিতে হবে যাতে করে কুয়াশার পানি ও থেমে থাকা জীবাণু ধুয়ে ফেলতে হবে। যাতে করে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম হবে বলে জানান কৃষিবিদ কামরুন্নাহার তামান্না।

ঘরে বসে মাশরুম চাষ করা যায় খুব সহজেই। করোনাকালে যারা ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছেন তারা এটি চাষ করতে পারেন। মাশরুম অনেক পুষ্টিকর খবার। এই সময়ে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন হাই প্রোটিনযুক্ত ডায়েটের। মাশরুম হাই প্রোটিনযুক্ত। হজম হয় তাড়াতাড়ি। প্রোটিন ছাড়াও এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজপদার্থ।
বিশ্বজুড়ে চাষ করা হয় নানা জাতের মাশরুম। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এবং তুলনামূলক সহজ পদ্ধতিতে ঘরে ফলানোর জন্য উপযুক্ত অয়েস্টার, মিল্কি, প্যাডি স্ট্র জাতীয় মাশরুম। অয়েস্টার মাশরুম ফলানোর পক্ষে আবার শীতকাল উপযুক্ত। বাকি দুটোর উপযুক্ত সময় মার্চের পর থেকে, যখন ঠান্ডা কমে যায়।

জেনে নিন ঘরে বসে যেভাবে মাশরুম চাষ করবেন,-
অয়েস্টার মাশরুম চাষের উপকরণ: প্রধানত তিনটি উপকরণ দরকার এই ধরনের মাশরুম চাষ করার জন্য। এগুলো হচ্ছে,- স্পন বা মাশরুমের বীজ, খড় ও পলিথিনের ব্যাগ।
চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায় এমন দোকানে, মাশরুম প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এবং অনলাইন শপিং সাইট থেকে মাশরুমের বীজ কিনতে পাওয়া যাবে। বাকি উপকরণগুলো সহজে জোগাড় করা যায়।

পদ্ধতি: চাষের জন্য প্রথমে আধ থেকে এক ইঞ্চি মাপের খড় কেটে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত গরম পানিতে প্রায় ২০ মিনিট ফুটিয়ে নিন অথবা ব্লিচিং পাউডার ও চুন মেশানো পরিষ্কার পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। ফোটানো বা ভেজানোর পরে পানি এমনভাবে ঝরিয়ে নেবেন, যাতে হাত দিয়ে খড় চাপলে পানি না পড়ে অথচ হাতে একটা ভেজা ভাব থাকবে। এরপর একটি পলিব্যাগের মধ্যে দু’ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর ব্যাগের ধার ঘেঁষে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে।
বীজের উপরে আবার খড় ও খড়ের উপর আবার বীজ, এইভাবে প্রায় সাত-আটটা স্তর তৈরি করে পলিব্যাগের মুখ কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে কষে বন্ধ করে দিন। খড় বিছানোর সময় প্রতিবার হাত দিয়ে ভালো করে চেপে দিন, যাতে খড়ের ভিতর হাওয়া জমে না থাকে।

এরপরে প্যাকেটে দশ থেকে বারোটা ছোট ছোট ছিদ্র করে তুলা দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিলে স্বাভাবিক হাওয়া চলাচল বজায় থাকবে, আবার তুলা থাকায় ধুলাও ঢুকতে পারবে না। প্যাকেটটি সাত থেকে দশ দিনের জন্য কোনও অন্ধকার জায়গায় রেখে দিন।
খেয়াল রাখবেন, অন্ধকার হলেও জায়গাটিতে যেন হাওয়া চলাচল করে। জায়গাটি যাতে পরিষ্কার ও পোকা-মাকড়মুক্ত থাকে, সে খেয়ালও রাখতে হবে। মাছি কিন্তু মাশরুম চাষে ভয়ানক ক্ষতি করে।

কয়েক দিনের মধ্যেই সেই প্যাকেটে বীজের জায়গায় সাদা আস্তরণ দেখা দেবে, যাকে মাইসেলিয়াম বলে। অল্প কয়দিনের মধ্যে পুরো ব্যাগটাই মাইসেলিয়ামে ভরে গেলে তুলো সরিয়ে ফেলে আরও কয়েকটি ছিদ্র করে ব্যাগটিকে কিছুটা আলোর মধ্যে রাখতে হবে।
তবে সরাসরি রোদে নয়, ঘরের ভিতর যেটুকু আলোয় বই পড়া যায়, তেমন আলোয়। বাতাসে আর্দ্রতা বুঝে প্রয়োজন মাফিক প্যাকেটের উপরে মাঝে মাঝে জল স্প্রে করবেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই ছিদ্র দিয়ে মাশরুমের পিনহেড উঁকি দেবে। সাধারণত পঁচিশ থেকে তিরিশ দিনের মধ্যে মাশরুম খাওয়ার মতো পরিণত হয়ে যায়। একটি ব্যাগ থেকে তিনবার ফলন পাওয়া যায়।

কম খরচে অধিক লাভ হওযায় ভোলার চরাঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে বিদেশি সবজি ক্যাপসিকাম চাষ। আর বিদেশি এ সবজি চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে চাষিদের। সরকারিভাবে ক্যাপসিকাম চাষে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেয়ে ভোলার চরাঞ্চলে এ সবজি চাষের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে দাবি করছেন চাষিরা। অন্যদিকে রপ্তানীতেও সুবিধা চান তারা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নে মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা মাঝের চর ও দৌলতখান উপজেলার চর মদনপুর ইউনিয়নের চর মদনপুরে প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর আগে মনির পাঠান নামে এক কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি সবজি ক্যাপসিকাম চাষ শুরু করে।

প্রথম বছর সফলতা পেয়ে পরবর্তী বছর বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি এ সবজির চাষ শুরু করেন। কম খরচে অধিক লাভজনক হওয়ায় গত ৩ বছরে এ সবজির চাষ ও চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ গুণ। বর্তমানে ভোলার সদরের মাঝের চর ও দৌলতখানের চর মদনপুরে প্রায় ১৫০ একর জমিতে প্রায় ৩০০ জন চাষি ক্যাপসিকাম চাষ করছেন।
ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চরের ক্যাপসিকাম চাষি মো. তছির ফরাজী জানান, গত ৫ বছর ধরে এ চরে তিনি ক্যাপসিকাম চাষ করছেন। এবছরও তিনি ১ একর জমিতে চাষ করেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। খেতে প্রচুর ফলন হয়েছে।
যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ ফলন হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করেছেন আর খেতে যে পরিমাণ ফলন আছে তাকে আরো ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন। তিনি আরো জানান, গত বছর খেতে কিছুটা পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থাকলেও এবছর সময় মত কিটনাশক ব্যবহার করায় পোকার আক্রমণ নেই।

দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চর মদনপুরের ক্যাপসিকাম চাষি মো. শেখ ফরিদ জানান, আমার এক বন্ধুর ক্যাপসিকাম চাষ করে অধিকলাভবান হয়েছে। এটা দেখে আমি তার সাথে আলাপ করে গত ৩ বছর ধরে ক্যাপসিকাম চাষ শুরু করি। ক্যাপসিকাম চাষ করে আমিও লাভবান হয়েছি।
তিনি আরো জানান, এ চরে আমরা আগে ২০থেকে ৩০ জন চাষি ক্যাপসিকাম চাষ করতাম। অধিক লাভজনক হওয়ায় দিন দিনই চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাপসিকাম চাষে কোন লোকসান নেই।
একই এলাকার ক্যাপসিকাম চাষি আব্দুল রব জানান, খেত থেকে আমরা ক্যাপসিকাম তুলে প্যাকেট করি। এরপর লঞ্চে করে ঢাকায় নিয়ে পাইকারী আড়তে বিক্রি করি। যদি ভোলার বাজারে ক্যাপসিকাম বিক্রি করা যেতো তাহলে আমাদের কষ্ট কম হতো ও আরো অধিক লাভ করতে পারতাম।
১নং চর মদনপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. আলাউদ্দিন জানান, চর মদনপুর ও কাচিয়ার মাঝের চরে বর্তমানে ১০০ কানি (১৬০ একর) জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো প্রশিক্ষণ বা সহায়তা পাই না। যদি সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পাই তাহলে আগামীতে আমরা দুই চরে ৫০০ কানি (৮০০ একর) জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করব। ভোলার চরাঞ্চলে ক্যাপসিকামের বিপ্লব ঘটনাতে পারবো।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ জানান, ভোলা জেলায় গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১৫ হেক্টর, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৩৭ হেক্টর এবং ২০২০-২১ অর্থ বছরে অনেক বেড়ে হয়েছে ৭০ হেক্টর। অথাৎ গত তিন বছরের পরিসংখানে বোঝা যায় লাভজনক এ সবজি চাষ ভোলায় দিন দিনই বাড়ছে।
তিনি আরো জানান, ক্যাপসিকাম বীজ বপনের তিন মাসের মধ্যে বিক্রির উপযোগী হয়। আমরা আগামীতে ভোলা জেলায় ক্যাপসিকাম চাষ বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরণের সহায়তা প্রদান করব। আশা করছি আগামী বছর ক্যাপসিকাম চাষ ৪ গুণ বাড়বে।
এছাড়াও কৃষকরা ভোলার বাজারে ক্যাপসিকাম বিক্রি করলে ভালো দাম পাবে না। কারণ ঢাকায় অনেক পাইকারি আড়ৎ রয়েছে সেখানে বিক্রি করে কৃষকরা অধিক টাকা আয় করতে পারছে।
অনুগ্রহ করে মন্তব্য করতে লগ ইন করুন লগ ইন